শুরু হলো উত্তাল মার্চ
আজ থেকে শুরু হলো উত্তাল মার্চ। স্বাধীনতার মাস, অগ্নিঝরা ইতিহাসের মাস, বিষাদ ও বেদনার মাস। এই মাসের ২৫ তারিখ থেকে লেখা শুরু হয়েছিল এক অমর মহাকাব্য; যার নাম বাংলাদেশ। বাঙালীর জীবনে ভাষা আন্দোলনের স্মারক মাস ফেব্রুয়ারির পর মার্চের গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের স্বাধীনতার জন্য চূড়ান্ত লড়াই শুরু হয় এই মার্চেই। একাত্তরের গোটা মার্চ মাসই ছিল অত্যন্ত ঘটনাবহুল।
১৯৭১ সালে এই সময়ে পাকিস্তানি জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বাঙালিদের ওপর শাসন ভার ছেড়ে দেওয়ার বিষয় নিয়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টসহ রাজনৈতিক নেতাদের বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং জুলফিকার আলী ভট্টো’র মধ্যকার বিভিন্ন আলোচনা চলছিলো। দিনের পর দিন চলছিলো ওই আলোচনা। কিন্তু তাতে কোনো অগ্রগতি হচ্ছিলো না।
সেই সময় বিবিসি’র সাংবাদিক মার্ক টালি বলেছিলেন, ‘মুজিব-ইয়াহিয়ার মধ্যকার আলোচনা ফলপ্রসূ হতে পারে না। কারণ আলোচনা চলছে দুই বন্দীর মধ্যে সবে মাত্র। একজন ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর হাতে বন্দী, অপরজন শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিকামী বাঙালি জনগণের হাতে বন্দী।’
১৯৭১ সালের ১লা মাচের্র দিনে ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক প্রভাতী’ পত্রিকায় দুটি গুরুত্বপূর্ণ খবর বেরিয়েছিল।
এক, পহেলা মার্চের আগের দিন পিআইএ বিমানযোগে পশ্চিম পাকিস্তানের কয়েকজন জাতীয় পরিষদ সদস্য ঢাকা এসে পৌঁছেছেন। তারা অধিকাংশই ওয়ালী-মুজাফফর ন্যাপের।
দুই, রোববার বিকেলে ঢাকা শিল্প ও বণিক সমিতির সংবর্ধনা সভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘জনাব ভুট্টো তার দলের ৮৩ জন সংসদ সদস্য নিয়ে ঢাকায় আসতে চান না। আমি যদি বলি ১৬০ জন সদস্য নিয়ে আমরা পশ্চিম পাকিস্তানে যাবো না? পরিষদের আলোচনায় না বসে আগে কী করে আমরা প্রতিশ্রুতি দেব যে ছয় দফা সংশোধন করা হবে? ছয় দফা এখন জনগণের সম্পত্তি, তাদের নির্বাচনীর রায়। ব্যক্তিগত ভাবে এর সংশোধন বা পরিবর্তনের অধিকার আমার নেই। আসলে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর বানচাল করার প্রক্রিয়া চলছে। এ চক্রান্ত অব্যাহত থাকলে পরিণামে যা ঘটবে তার জন্য চক্রান্তকারীরাই দায়ী হবেন।’
শেখ মুজিব বলেন, যদি একজন সদস্যও কোন ন্যায়সঙ্গত প্রস্তাব দেন, তা গ্রহণ করা হবে। আমরা আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে অন্যায় কিছু করব না।
এর দু’দিন পরই ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন। তাই সবার মনে উদ্বেল প্রতীক্ষা। আশা ও আশঙ্কার মিশ্র অনুভূতি। শেষ পর্যন্ত জনাব ভুট্টো তার মত পাল্টাবেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তার প্রতিশ্রুতি রাখবেন, এটাই বাঙালির প্রত্যাশা।
সকাল ১০টার আগেই জানাজানি হয়ে গেল, দুপুর ১টায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বেতারে ভাষণ দেবেন। কী নতুন কথা বলবেন তিনি? দুরুদুরু শঙ্কা, কম্পিত বুকে সবাই অপেক্ষায় রত। দুপুর ১টায় বেতার ঘোষক বললেন, এবার প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ভাষণ দেবেন। কিন্তু ইয়াহিয়ার কণ্ঠ নয়, প্রেসিডেন্টের বিবৃতি পাঠ করলেন বেতার ঘোষক- ‘জাতীয় পরিষদের বৈঠক ৩ মার্চ বসবে না। অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হল’।
আশা ভঙ্গের বেদনায় সবাই স্তম্ভিত। তারপরই গর্জে উঠল সারা ঢাকা। স্টেডিয়ামের খেলা ভেঙে তাঁবুতে আগুন ধরিয়ে হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ দর্শক বেরিয়ে এলো রাস্তায়। ঢাকা হাইকোর্টের সামনে একটি স্টেট বাস অগ্নিদগ্ধ হলো। লাখো বিক্ষুব্ধ মানুষ সমাবেত হলো হোটেল পূর্বাণীর সামনে। সেখানে বিকেলে চারটায় শেখ মুজিবের সাংবাদিক সভা।
বঙ্গবন্ধু সাংবাদিক সভা শেষ করে সমবেত জনতার উদ্দেশে বললেন, জাতীয় পরিষদের বৈঠক স্থগিত রাখা একটি চক্রান্তের পরিণতি ছাড়া আর কিছু নয়। সংখ্যাগরিষ্ঠদের মতামতকে উপেক্ষা করে সংখ্যালঘিষ্ঠ দলের প্রতিটি নেতার দাবি মেনে নেয়া হচ্ছে। এটি গণতন্ত্র নয়, স্বৈরতন্ত্র। এর প্রতিবাদে প্রথম কর্মসূচির অংশ হিসেবে পরদিন ঢাকায়, তারপরের দিন সারাদেশে হরতাল পালিত হবে এবং ৭ মার্চ রেসকোর্সে জনসভা হবে। এ সভায় ঘোষিত হবে আন্দোলনের পূর্ণাঙ্গ কর্মসূচি।
শেখ মুজিব আরও বললেন, আগামী ৭ মার্চের মধ্যে যদি বর্তমান পরিস্থিতির কোন পরিবর্তন ঘটানো না হয়, তবে ভবিষ্যতে যা ঘটবে তার জন্য তিনি দায়ী থাকবেন না।
পহেলা মার্চ আরও দুটি ঘটনা ঘটল। বাংলাদেশের গভর্নর ভাইস এডমিরাল আহসান পদচ্যুত হলেন এবং সামরিক প্রশাসক লে. জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খান অসামরিক প্রশাসনেরও দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। সামরিক প্রশাসনের ১১০নং সামরিক আইনের নির্দেশে বাংলাদেশের সংবাদপত্রে শেখ মুজিবের আহ্বানে যে আন্দোলন শুরু হয়েছে তার খবর ও ছবি ছাপা নিষিদ্ধ করা হলো।
প্রতিক্ষণ/এডি/নাজমুল